নিজস্ব প্রতিবেদক
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যেকোনো অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোয় কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে নানা রকম আশঙ্কা রয়েছে। উন্নত দেশ যেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের কিছুটা ভোগান্তি তো হবেই। আমাদের যেকোনো অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে। আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।দেশের মানুষ যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে সেজন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
গতকাল রাতে জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
নিজের বক্তব্যে দেশের আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিসহ সংকট মোকাবেলায় সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ডলারের ওপর চাপ বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ওপর একটা চাপ আছে। অবশ্য ঋণপত্র খোলার জন্য যে বাড়তি চাপ তা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে যেন ডলারের ওপর চাপ কাটিয়ে ওঠা যায়, সেদিকে আমরা দৃষ্টি দিয়েছি।
এ সময় দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতির বিশদ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মহামারীর কারণে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর সবকিছু উন্মুক্ত হওয়ায় আমাদের আমদানি বাড়তে থাকে। একই সময়ে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এ মুহূর্তে আমাদের যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে অন্তত পাঁচ মাসের আমদানি করা সম্ভব। যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের পণ্য আমদানি করার মতো রিজার্ভ থাকাই যথেষ্ট।
রিজার্ভের অর্থ কোথায় খরচ হয়েছে, সে প্রশ্নেরও জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা বিনামূল্যে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা দিয়েছি। এ টিকা কিনতে ডলার ব্যয় হয়েছে। সিরিঞ্জ কিনতে হয়েছে, মহামারীকালে চিকিৎসা কর্মীদের আলাদা ভাতা দেয়া হয়েছে। এর পেছনেও ব্যয় হয়েছে।
সরকার সার্বিক বিষয়ে সতর্ক রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠক করেছি। সামনে কী হতে যাচ্ছে সেটা একটা আশঙ্কার ব্যাপার। এখন থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের কী করণীয় সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের বিলাসদ্রব্য আমদানি কমাতে হবে। এর ওপর আমাদের ট্যাক্সও বসাতে হবে বেশি করে।
দেশবাসীকে উদ্দেশ করে শেখ হসিনা বলেন, দামি গাড়ি না চালালে, আঙুর-আপেল না খেলে কী হয়? এখন তো আমাদের দেশীয় ফল প্রচুর আছে। আমাদের তরমুজ, আমড়ার মতো অনেক দেশী ফল উৎপাদন হচ্ছে। এগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আমদানি পণ্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ ও তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। যুদ্ধের কারণে দেয়া পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় উৎপাদন কমেছে, পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়ছে, পণ্য পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মোটকথা গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে আলাদা নয়, তাই যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফল তাকেও ভোগ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি সংকট আরো ঘনীভূত করেছে।প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়েছে। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ বা যাদের জ্বালানি তেল, গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে হয়, তাদের সবাই সংকটে পড়েছে। তার পরও আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের ঋণ পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক নয় জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন, সরকারি ঋণ জিডিপির মাত্র ৩৬ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ কোনোদিনই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি।আমরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে যাই। আমরা কখনো ঋণখেলাপি হইনি, ভবিষ্যতেও হব না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অর্থনীতি সচল রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।সবাইকে বলব, প্রত্যেককে কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। অর্থ সাশ্রয় করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বিদ্যুতের সুইচ বন্ধ রাখতে হবে। সেলফোন, টিভি, টেলিফোন সবকিছুর ক্ষেত্রেই বিল যেন কম ওঠে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ইংল্যান্ডে এটি কড়াকড়িভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা ৮০ শতাংশ বিদ্যুতের বিল বাড়িয়েছে। সেখানে রেশন করা হয়েছে। আসন্ন শীতে কীভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা শুরু করেছে ইউরোপের দেশগুলো।
সরকার দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক কোটি মানুষকে ফ্যামিলি কার্ড দিয়েছি। তাদের ৩০ টাকা কেজি দরে চাল দিয়ে যাচ্ছি। তেল, চিনি, ডালও কম মূল্যে সরবরাহ করে যাচ্ছি।
খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমদানীকৃত জিনিসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পাশাপাশি কোন দেশে কী পণ্য রফতানি করা যায় তা খতিয়ে দেখতে হবে।রফতানির পরিমাণ বাড়ানোর জন্যও আমরা চেষ্টা করছি।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেয়াল রাখতে হবে যেন নিজের ঘরেই এডিস মশার বিস্তার না ঘটে। প্রত্যেককে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে।
বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বাস মালিকরা যদি বাস না চালান তাহলে আমরা কী করতে পারি? ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে।তাদের জনগণ কেন ভোট দেবে? খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাগারে গিয়েছিলেন। তাকে যদি বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
বাজেটে সরকার ভর্তুকি ধরে রেখেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, পরিবহন খরচ বাড়ায় ভর্তুকির চাহিদা বেড়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। সেখানে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যদি আমরা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ দিতে চাই, তাহলে এ ভর্তুকি দিতে হবে। জ্বালানি তেলে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ১৯ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।খাদ্য আমদানিতে লাগছে ৪ হাজার কোটি টাকা। টিসিবিসহ জনবান্ধব কর্মসূচিতে অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে ৯ হাজার কোটি টাকা। কৃষি খাতে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ৪০ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা শুধু ভর্তুকি চাহিদা বেড়েছে।
গ্যাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটারে ১০ টাকা ৬০ পয়সা করে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বলে জানান শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, শিল্প-কারখানার এলএনজির প্রতি ঘনমিটারে ৪৮ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গত এক বছরে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে। চাল, গম ও আটার দাম বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ করে। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যয় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্যদ্রব্য রিজার্ভ থাকার পরেও বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমদানি করেছে সরকার। রশিয়া বাধা সরিয়ে নেয়ায় ইউক্রেন থেকে গম ও তেল আসতে শুরু করেছে। দেশে আমন ও আউশ ধান লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি আবাদ হয়েছে। বোরো ফসলও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করি। আমরা খাদ্যোৎপাদনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি এখন। যে কারণে আমি আহ্বান করছি, দেশের কোথাও যেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে।