রবিবার | ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Cambrian

আহমেদীয়া ফাইন্যান্সের অধিক লভ্যাংশের ফাঁদ

spot_img
spot_img
spot_img

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৪ লাখ টাকা আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কর্মাস এমসিএস লি. এ জমা রেখেছিলেন মিরপুরের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির লভ্যাংশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত লভ্যাংশও তো দূরের কথা, মূল টাকাও ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। মূল টাকার ফেরত না পেয়ে দুশ্চিন্তায় আব্দুর রহিম স্ট্রোক করে মারা যান।

স্ত্রী মর্জিনা বেগম(৫০) ক্রন্দন কণ্ঠে বলেন, স্বামী মারা গেলো, ব্যবসাও বন্ধ, ৩৪ লাখ টাকাও আটকা, লভ্যাংশও পাচ্ছি না। আমি তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে আছি। ছয় মাস ধরে বাড়ি ভাড়াও দিতে পারছি না।

মর্জিনা বেগম বলেন, পায়ে ধরেছি, অনুনয়-মিনতি করছি, টাকাটা ফেরত দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি, অফিসে গেলে মারতো, হুমকি দিতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ আমাদের টাকাগুলো ফেরতের ব্যবস্থা করার জন্য।

শুধু মর্জিনা বেগম নন, অধিক লাভের আশায় আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কর্মাস এমসিএস লি. এ প্রায় ১১শ’ আমানতকারী সেখানে তিন শতাধিক কোটি টাকা রেখেছেন। কেউ ডিপিএস, কেউ এফডিআর করেছেন, কেউ বা মাসিক ১২ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশের চুক্তিতে সেখানে টাকা রেখেছেন। প্রথমে লভ্যাংশ পেলেও পরে লভ্যাংশ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসল টাকাও নেই।

গ্রাহক ও আমানতকারীরা বলছেন, রাজধানীর কাফরুল থানাধীন ইব্রাহিমপুর এর ৮২/৪, এ ৪র্থ তলায় আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কর্মাস এমসিএস লি. এর কার্যালয়। দেড় দশকের বেশি বয়সী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালাক মো. মনির আহমেদ ও মহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজন প্রায় ১১ শত গ্রাহক-আমানতকারীর টাকা আত্মসাতের মূলহোতা। তারা এই মূহুর্তে পলাতক।

রাজধানীর ক্র্যাব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী প্রতারিত আমনতকারীরা। পরে ক্র্যাব কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করেন তারা।

সেখানে কথা হয় এক প্রতারিত গ্রাহকের সঙ্গে। গিয়াস উদ্দিন নামে ওই গ্রাহক বলেন, তিন বছরের চুক্তিতে সেখানে মাসিক ২৩ হাজার টাকা লভ্যাংশ পাবার আশায় ১০ লাখ টাকা দেই। প্রথমে কয়েক মাস লভ্যাংশ পেলেও ২০২১ সাল থেকে দিচ্ছে না। মূল টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। এরকম শত শত ভুক্তভোগী অফিসে ঘুরে লভ্যাংশ তো দূরের কথা মূল টাকাই ফেরত পাচ্ছি না। আ আমরা শত শত পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছি। সারা জীবনের অল্প অল্প করে গচ্ছিত সঞ্চয় আজ হারাতে বসেছি।

প্রতারিত গ্রাহকরা জানান, দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, অবসর প্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্য, পুলিশ সদস্য, বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। বিভিন্ন সরকারী চাকুরীজীবী অসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের পেনশন গ্রাচুইটির টাকা এখানে দীর্ঘ মেয়াদী এফডিআর করেছেন। মনির আহমেদ সাইফুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণের মিথ্যা প্রলোভনে বিশ্বাস করে প্রতিষ্ঠানে এফডিআরসহ মাসিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় গ্রাহকগণ টাকা জমা দেয়। সেই জমাকৃত অর্থ দ্বারা আহমেদীয়া এপার্টমেন্ট এন্ড ডেভেলপার (প্রাইভেট) লি., আহমেদীয়া টুইন টাওয়ার, ইউরো স্টার মডেল টাউন, ইউরো স্টার টাওয়ার, ইউরো স্টার অটো গ্যাস স্টোপ ফ্যাক্টরি, ইউরা স্টার পাম্প ফ্যাক্টরি, ইউরো স্টার হোম এ্যাপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি ইত্যাদি নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।

কর্পোরেট অফিস ২৮/এ-১, ২য় তলা, পশ্চিম মেইন রোড, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা-১২০৬ থেকে সমস্ত কিছু পরিচালনা করে। বিগত তিন বছর যাবত আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কমার্স এমসিএস লিঃ গ্রাহকের কোন প্রকার লভ্যাংশ ও মেয়াদ উত্তীর্ন এফডিআর এর টাকা পরিশোধ, এমনকি মূল জমাকৃত টাকাও ফেরত প্রদান করছে না।

গ্রাহকরা অফিসে টাকার জন্য আসলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থপনা পরিচালকসহ তার কর্মকর্তারা গ্রাহকদের সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে। এমনকি গ্রাহকগণকে অনেক সময় মারধরসহ বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে আসছে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর শত শত ভূক্তভোগী গ্রাহকগণ আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কমার্স এমসিএস লি. এর অফিসে পাওনা টাকার জন্য অবস্থান ও অনশন শুরু করে।

আমনতকারীরা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। কিন্তু অসাধু কিছু ব্যক্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করছে।

টাকা ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেয়া সিরাজুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। পুরো পরিবার মিলে ৭০ লাখ টাকা দিয়েছি ২০১২ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাখে ১৫০০ টাকা দিতো। ২০১৯ সালের পর লভ্যাংশ দেয়া বন্ধ করে দেয়। মূল টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।

তিনি বলেন, অফিসে গিয়ে মূল টাকা ফেরত চাইলে নানাভাবে চলচাতুরি করে কথা ঘুরাচ্ছে। কখনো হুমকি দিচ্ছে। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাটপারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আজকে আমরা ১১শ’ গ্রাহক রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি।

সুলতানা রাজিয়া নামে আরেক নারী প্রতারিত গ্রাহক বলেন, ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা আমানত হিসেবে রেখেছি। চুক্তিতে ছিল আমি টাকা ফেরত চাইলে তারা এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হবেন। আমার টাকার চুক্তির মেয়াদ শেষ। কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছে না। টাকা ফেরত চাইলে প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা গত মাসের ৫ তারিখ থেকে অফিসে অনশন করছি। অফিস ছেড়ে তারা বাইরে আত্মগোপনে গেছেন।

রাজিয়া বলেন, আমরা কই যাবো? কার কাছে গেলে টাকা ফেরত পাবো? পুলিশ আমাদের সহযোগীতা করছে না। আহমেদীয়া ফাইন্যান্স এন্ড কর্মাস এমসিএস লি. এর কর্মকর্তারাও দেখা করছেন না, অফিসে আসেন না।

এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কাফরুল থানা ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা শুরু থেকে মামলা করতে বলছি। কিন্তু আমানতকারীরা মামলা করতে রাজি নন। উল্টো তারা প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় দখল করে আছেন এক মাস। কর্মকর্তারাও আসেন না। অফিসিয়াল কার্যক্রমও বন্ধ। টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। প্রতিষ্ঠানটির অধিকাংশ গ্রাহক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারি, ব্যবসায়ী। এটার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মামলা হলে পুলিশ আইনী পদক্ষেপ নিতে পারতো।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালাক মো. মনির আহমেদের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিটিং এ আসি, পরে কথা বলবো।

- Advertisement -spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ